সরিষা চাষের উপযুক্ত সময় এবং সরিষা চাষে মাটির বৈশিষ্ট্য

সরিষা চাষের উপযুক্ত সময় এবং সরিষা চাষে মাটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি আবার অনেকেই জানিনা। তাই আজকে আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব সরিষা চাষের উপযুক্ত সময় এবং সরিষা চাষে মাটির বৈশিষ্ট্য।

সরিষা-চাষের-উপযুক্ত-সময়-এবং-সরিষা-চাষে -মাটির-বৈশিষ্ট্য

সরিষা হলো তেল জাতীয় ফসল। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় চার লক্ষ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করে থাকে। সরিষা চাষ একটি লাভজনক ফসল। যা নিজের পরিবারের তেলের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবেও লাভবান হওয়া যায় । তাহলে দেরি না করে মূল আলোচনা যাওয়া যাক-

পোস্ট সূচীপত্রঃসরিষা চাষের উপযুক্ত সময় এবং সরিষা চাষে মাটির বৈশিষ্ট্য

সরিষা চাষের উপযুক্ত সময়

সরিষা শীতকালীন ফসল। আদ্র এবং শুষ্ক আবহাওয়া প্রয়োজন সরিষার চাষের জন্য। বাংলাদেশের প্রায় চার লক্ষ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষবাদ আড়াই লক্ষ টন তেল পাওয়া যায়। বিভিন্ন জাতে সরিষার বীজে প্রায় ৪০-৪৪% তেল থাকে। খৈলে প্রায় ৪০% আমিষ থাকে। তাই খৈল গরু ও মহিষের জন্য খুব পুষ্টিকর খাদ্য। 

বিভিন্ন অঞ্চলের তারতম্য এবং জমির জো অবস্থা অনুসারে টবি ৭, কল্যাণী, সোনালী সরিষা, বারি সরিষা ৬,বারি সরিষা ৭ , বারি সরিষা ৮, এর বীজ মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য কার্তিক মাস (অক্টোবর) পর্যন্ত বোনা যায়। রাই ৫, এবং দৌলত কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ মধ্য আসীন থেকে মধ্য নভেম্বর মাস পর্যন্ত বপন করা যেতে পারে। বিভিন্ন অঞ্চলের তারতম্য এবং জমির জো অবস্থা অনুসারে বারি সরিষা ১৩ জাতের বীজ কার্তিক মাসে প্রথম সপ্তাহ থেকে শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত (অক্টোবর থেকে মধ্য নভেম্বর) উপযুক্ত সময়।

সরিষার চাষে মাটির বৈশিষ্ট্য

সরিষা চাষের জন্য মাটি নির্বাচন করার গুরুত্বপূর্ণ। ভালো সু নিষ্কাশিত পানি জমে না এমন জমিতে সরিষা চাষ করলে ভালো ফলন দেয়। সরিষা চাষে মাটি দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটিতে ভালো জন্মে। মাটির PH ৬ থেকে ৭.৫ এর মধ্যে থাকলে ভালো হয়। উর্বর এবং মাঝারি উর্বর জমিতে চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। ছায়া মুক্ত সারাদিন রোদ পরে এরকম জমি নির্বাচন করতে হবে।

আরো পড়ুনঃকরলা চাষের উপযুক্ত সময় এবং করলা চাষের মাটির বৈশিষ্ট্য

বর্ষায় পানি জমে থাকে এইরকম জমিতে সরিষা চাষ করলে ফলন হয় না।বর্ষাকালে প্রধানত বোনা আমন ও রোপা আমনের জমিতে শীতকালীন ফসল হিসেবে সরিষার চাষ করা হয়৷ এছাড়া আন্তঃফসল হিসেবে উর্বর জমিতে এবং ফল বাগানে সরিষার চাষ করা যাই। তবে লোনা মাটিতে সরিষা চাষ করা যায় না।

সরিষা চাষের জন্য জলবায়ু

সরিষা হলো শীতকালীন ফসল। শুষ্ক এবং আর্দ্র আবহাওয়া/জলবায়ু প্রয়োজন সরিষা চাষের জন্য। সাধারণত তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর মধ্যে থাকলে সরিষার ফলন ভালো হয়। সরিষার চাষ এলাকায় পর্যাপ্ত মৌমাছি থাকতে হবে৷ এতে সরিষার পরাগায়ন ভালো হয়৷ কীটনাশক প্রয়োগে মৌমাছি না আসলে ফসল কম হয়। বৃষ্টি হীন পরিবেশ সরিষা চাষের জন্য ভালো।

সরিষা চাষের জমি প্রস্তুত

জমিতে ৪-৫ টি চাষ দিতে হবে। মাটি যদি ঢিলাযুক্ত হয় তাহলে মাটি ঝুরঝুরা করে নিতে হবে। সরিষার জমিতে যদি চাষ কম হয় তাহলে সরিষা বীজের অঙ্কুরোদগমের ব্যাঘাত ঘটে। মাটি যদি ঢিলাযুক্ত হয় তাহলে মই দিয়ে ঢিলা গুলো ভেঙে সমতল করে নিতে হবে। জমি চাষ করার সময় আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হবে যেন সরিষার ক্ষেতের আগাছার প্রকোপ কম হয়।


সরিষার বীজ রোপনের ১০-১২ দিন আগে জমি চাষ করে ফেলে রাখতে হবে প্রখর রোদে। প্রত্যেকটা চাষের জন্য ২ দিন করে গ্যাপ রাখতে হবে। কারণ চাষ দেওয়ার সময় নিচের মাটি উপরে আসে এতে রোগ জীবাণু বহনকারী পোকামাকড় বাইরে বের হয়ে আসে। জমি চাষ দিয়ে দুইদিন ফেলে রাখলে রোদের তাপে অথবা পাখিরা পোকামাকড় খেয়ে ফেলে।

সরিষার বীজ  শোধনকরণ

বীজ রোপণের আগে বীজ শোধন করে নেওয়া জরুরী। কারণ অনেক বীজ বাহিত রোগ থাকে যা ফলন কমায়। তাই বীজ বাহিত রোগ থেকে মুক্তি পেতে বীজ শোধন করা জরুরী।বীজ বপনের পূর্বে ভিটাভেক্স-২০০ অথবা ক্যান্টন দিয়ে (২-৩ গ্রাম ছত্রাক নাশক/ কেজি বীজ) বীজ শোধন করে বপন করতে হবে৷ বিনা সরিষার বীজ ব্যাভিষ্টিন (২.৫ গ্রাম/ কেজি) বা বেনলেট (১.৫ গ্রাম/ কেজি) দিয়ে শোধন করতে হবে৷

সরিষার বীজ রোপণ পদ্ধতি

বাংলাদেশের সাধারণত সরিষা বীজ ছিটিয়ে রোপন করে। তবে সারিতে বীজ বপন করলে গাছের পরিচর্যা করা সহজ হয়। তবে সরিষার বীজ ছিটিয়ে রোপন করার থেকে সারিতে রোপণে খরচ বেশি। আবার ফলনও কম হয়। 

সরিষার জমিতে সার প্রয়োগ 

সরিষার জমিতে সার প্রয়োগ করা অত্যন্ত জরুরী। কারণ জমি যদি বতর না থাকে তাহলে সরিষা চাষ করে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। তাই সরিষার জমিতে জৈব সার, কম্পোস্ট সার এবং রাসায়নিক সার দিতে হয়। জমি চাষের আগে আপনি যদি গোবর, ছাই এবং কম্পোস্ট সার দিয়ে যদি জমি হাল চাষ করেন। তাহলে জমির উর্বর হবে এবং রাসায়নিক সার ও জৈব সার তুলনামূলক কম লাগবে।

আরো পড়ুনঃশসা চাষের উপযুক্ত সময় এবং শসা চাষের মাটির বৈশিষ্ট্য

ইউরিয়া বীজ বপনের ৩০ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে ১-২ বার প্রয়োগ করতে হবে ৷ ইউরিয়ার উপরিপ্রয়োগ প্রয়োগ করতে হবে ৷ ইউরিয়ার উপরিপ্রয়োগের পূর্বে জমির আগাছা দমন করতে হবে ৷ অর্ধেক ইউরিয়াও অন্য সব সার জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে।ইউরিয়ার উপরিপ্রয়োগের পর জমিতে সেচ দিতে হবে।

সরিষার জমিতে সেচ ব্যবস্থা  

সরিষার জমিতে সেচ ব্যবস্থা রাখতে হবে। কারণ জমিতে মাঝে মাঝে সেচ দিয়ে মাটি ভিজিয়ে দিতে হয়। অনেক সময় দেখা যায় মাটির রস সব চুষে উপরিভাগ ফেটে যায় তখন হালকা করে সেচ দিতে হয়। সরিষার বীজ ছিটিয়ে দেওয়ার পরপরই হালকা করে সেচ দিতে হবে। দ্বিতীয়বার সেচ দিতে হবে বীজ রোপনের ১০-১২ দিন পর। তবে অবশ্যই আপনাকে আবহাওয়া অনুযায়ী সেচ দিতে হবে।

সরিষার জমিতে আগাছা দমন

বীজ বপনের ১৫-২০ দিন পর একবার এবং ফুল আসার সময় একবার নিড়ানি দিতে হয়। জমি আগাছা দমন করলে ফলন ভালো হয় এবং পোকামাকড় ও রোগ বালাই কমে। আগাছা পরিষ্কার করার সময় অনেক জায়গায় দেখা যায় যে, বেশি গাছ রয়েছে তখন গাছগুলো পাতলা করে দিলে রোগবালাই কম হয়। পর্যাপ্ত আলো বাতাস পায় এবং ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব।

সরিষা-চাষের-উপযুক্ত-সময়-এবং-সরিষা-চাষে -মাটির-বৈশিষ্ট্য

সরিষার জমিতে পোকামাকড় ও রোগ বালাই

সরিষার গাছে বিভিন্ন জাতের পোকার আক্রমণ হতে পারে। এসব পোকার মধ্যে প্রধান প্রধান ক্ষতিকর পোকা এবং প্রতিকার বা দমন পদ্ধতি আলোচনা করা হলো।

জাব পোকাঃপূর্ণবয়স্ক ও বাচ্চা উভয়ই সরিষার পাতা, কাণ্ড, ফুল ও ফল হতে রস শুষে নেয়৷ আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে ফলের বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়, পাতা কুঁকড়ে যায়৷পোকা এক প্রকার রস বের করার ফলে মোল্ড ছত্রাক জন্মে আক্রান্ত স্থান কালো হয়৷ফল ধারণ অবস্থায় বা তার পূর্বে আক্রমণ হলে প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে সম্পূর্ণ ফসল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রতি গাছে ৫০টির বেশি পোকা থাকলে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি বা সুমিথিয়ন ৫৭ ইসি স্প্রে করতে হবে।

আরো পড়ুনঃআদা চাষের জন্য ১০টি সেরা পদ্ধতি

পরজীবীঃঅলটারনারিয়া ব্রাসিসি নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগের সৃষ্টি হয়৷প্রথম দিকে সরিষা গাছের নিচে বয়স্ক পাতায় এ রোগের লক্ষণ দেখা যায়।এ ছত্রাকের আক্রমণে গাছের পাতা, কাণ্ড ও ফলে চক্রাকার কালচে দাগের সৃষ্টি হয়৷আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পাতা ঝলসে যায়৷ ফলে সরিষার ফলন খুব কমে যায়৷রোগমুক্ত বীজ বপন করতে হবে৷বীজ বপনের পূর্বে ভিটাভেক্স-২০০ অথবা ক্যান্টন দিয়ে (২-৩ গ্রাম ছত্রাক নাশক/ কেজি বীজ) বীজ শোধন করে বপন করতে হবে৷

ডাউনি মিলডিউঃএই রোগে চারার বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়।পাতায় সাদা দাগ হয় এবং নিচের দিকে দাগগুলো বেশি দেখা যায়৷ফলন কমে যায়৷রিডোমিল ৭২ দিয়ে  বীজ শোধন।রিডোমিল ৭২ অথবা ডাইথেন এম ৪৫,০.২% স্প্রে করতে হবে ৫ থেকে ৭ দিন পরপর।

ফসল পরিপক্কতার লক্ষণ

মাঠের তিন চতুর্থাংশ পাতা বিবর্ণ বা হলদে হলেই বুঝতে হবে সরিষা পরিপক্ব হয়েছে৷ এই অবস্থায় ফসল সংগ্রহ করতে হবে৷ গাছ বেশি পরিপক্ব হলে ফল ফেটে বীজ মাটিতে পড়ে যায়। যে কোন সরিষা মাঠে৮০-১০০ দিন পর্যন্ত থাকে। এর বেশি হলে ফল পেকে মাটিতে ঝরে পড়ে। তাই ফসল অতিরিক্ত পাকার আগেই সংগ্রহ করতে হবে।

মাঠ থেকে ফসল সংগ্রহ

সকালে ফসল তুলতে হয়৷ ফসল সংগ্রহের জন্যে গাছ শিকড়সহ টেনে তোলা বা কাঁচি দিয়ে গাছ মাটির সমানে কেটেও নেওয়া যায়৷ ফসল তুলে তা কয়েকদিন রোদে শুকিয়ে গরু বা লাঠি দিয়ে টিটিয়ে মাড়াই করতে হয়৷ গাছ পরিবহনের সুবিধার্থে ছোট ছোট আঁটি বেঁধে নেওয়া হয়৷ ফসল মাড়াই করার পর কয়েকদিন রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়৷ বীজের আদ্রতা ৬-৮% হলে তা সংরক্ষণের উপযুক্ত হয়৷

ফসল সংরক্ষণ

ফসল সংরক্ষণ করার পূর্বে খেয়াল রাখতে হবে যেন তাতে মাটির ঢেলা বা আবর্জনা না থাকে৷ বায়ুরুদ্ধ পাত্র বা পলিইথাইলিন লাইনিং করা বস্তায় সরিষা রাখা যায়৷ সরিষার পাত্র বা বস্তা ঠান্ডা বা শুষ্ক স্থানে রাখতে হবে।

শেষ কথাঃ, সরিষা চাষের উপযুক্ত সময় এবং সরিষা চাষে মাটির বৈশিষ্ট্য

প্রিয় পাঠক, আজকের এই আর্টিকেলের মাধ্যমে সরিষা চাষের উপযুক্ত সময় এবং সরিষা চাষে মাটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। অবশ্যই আর্টিকেল পড়ে আপনারা সরিষা চাষের প্রয়োজনীয় সবকিছু বুঝতে পেরেছেন। তবে একটা কথা না বললেই নয় সেটা হলো সবকিছুরই যত্ন লাগে। কথায় আছে যত্ন করলে রত্ন মিলবে। তাই সঠিক পরিচর্যা ও যত্ন করে সরিষা চাষ করে অধিক ফলন ঘরে তোলে আর্থিক লাভবান হন।

পোস্টটি ধৈর্য সহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। পোস্টটি পড়ে যদি আপনার ভালো লাগে তাহলে কমেন্ট করবেন। আমাদের নতুন নতুন পোস্ট পেতে ওয়েবসাইটটি সাবস্ক্রাইব করে পাশে থাকা বেল আইকনটি ক্লিক করে আমাদের পাশে থাকবেন। ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ফকটেক ২৪ এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন

comment url